গল্প- বীণার সংসার

বীণার সংসার
– রাখী চক্রবর্তী

 

 

“খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা, নিরজনে প্রভু নিরজনে”
কোথায় গেলে, তাড়াতাড়ি এসো,
-হ্যাঁ বলো
-এই দেখো আজ আবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলাম।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছে শুনে বীণা গানটা থামিয়ে দরজার পাশে দাড়িয়ে রইল।

“বীণা দে।
বয়স- পঁয়ত্রিশ
গাত্র বর্ণ- কালো
শিক্ষাগত যোগ্যতা- উচ্চ মাধ্যমিক পাস”
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন কাল বের হবে।

বীণার মা-বাবা উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে এবারও যদি কোন পাত্রপক্ষ না আসে।বিজ্ঞাপনে অনেক টাকা চলে যায়। এদিকে মেয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। চিন্তার শেষ নেই।
বীণার বাবা অসীমবাবু বারবার বলেন মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা লিখলে অনেকেই যোগাযোগ করবে। কিন্তু বীণার মা লতিকাদেবী বলেন যখন বাড়িতে এসে মেয়েকে দেখবে তখন তো মিথ্যেবাদী হয়ে যাব। অসীমবাবু বলেন, তাহলে থাকো যুধিষ্ঠিরের মা হয়ে ।

বীণা সব শুনে চুপ করে থাকে। মায়ের ওপর এক এক সময় রাগ করে ও, কি ক্ষতি হতো যদি শ্যামলা বর্ণ লেখা হয়।বীণা বাবার কথায় সায় দেয় চোখে মুখে। মার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয় বীণা।

যাই হোক শেষমেষ বীণার কপালে জুটলো শ্বশুর ঘর। স্বামী অবশ্য কালো, তা যাই হোক শ্বশুর ঘর জুটল তো।ঠিকঠাক চলছিল বীণার ঘর সংসার। বিয়ের এক বছরের মাথায় বীণার গর্ভে সন্তান এলো।বীণার শ্বশুর বাড়ির কেউ এতো তাড়াতাড়ি সন্তান চায়নি। অনেক খরচাপাতি হয় একটা বাচ্চা জন্ম দিতে। অতএব দু’ তিন বছর যাক তারপর দেখা যাবে।

বীণার সর্ব শরীর কাঁপতে লাগল ওদের কথা শুনে। যত রাত বাড়ছে বীণা তত ওর সন্তানের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে- বাঁচাও মা, আমাকে মেরো না,
পেটের ওপর হাত ভুলিয়ে বীণা বললো, আমি বেঁচে থাকলে তুইও প্রাণ পাবি।

পরদিন ভোরে বীণার স্বামী আনন্দ ঘুম থেকে উঠে দেখে বীণা বিছানায় নেই। এতো ভোরে বীণা কোথায় গেল। খোঁজ চললো।বীণার বাবার কাছে খবর গেল। না ও বাড়িতে যায়নি বীণা । আনন্দ বুঝতে পেরেছে কেন বীণা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। গর্ভের সন্তানকে বীনা কখনই হত্যা করতে পারবে না।
এই ঘটনার আটমাস পর “শিশুনিকেতন ভিটেমাটি” থেকে একটা ফোন এল। আনন্দ ফোনে জানতে পারল কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে বীণা সাহা। আনন্দ সাহা মেয়ের বাবা হয়েছে।
বীণার শ্বশুর বাড়ির সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিল।মেয়ে মানে খরচ বাড়লো। দরকার নেই ওদের এ বাড়িতে আসার। যেখানে নিজের খুশিতে গেছে সেখানেই থাক মেয়েকে নিয়ে।

বীণার মা অতো গরজ করছে না। মেয়ে নাতনিকে নিয়ে। আসলে ওনারা নাতির মুখ দেখবে বলে মুখ উঁচিয়ে ছিলেন। দু’বার “শিশুনিকেতন ভিটেমাটি “তে ফোনও করেছিল। নিরাশ হয়ে গেল বীণার মা বাবা।ভয় একটাই শিশু সন্তানের গায়ের রঙ যদি কালো হয়। মেয়ে জামাই দুজনেই তো কালো।

বীণা “শিশুনিকেতন ভিটেমাটি “র সব অনাথ শিশুদের লালন পালন করছে নিজের সন্তান তো আছেই। সব শিশু আদরের। বোঝে না অনেকেই বোঝে না। গায়ের রঙ কালো বলে অবহেলিত বীণা। কিছুতেই অবহেলিত হতে দেবে না বীণা নিজের সন্তান বা “শিশুনিকেতন ভিটেমাটি”র সন্তানদের।
পুঁথিগত শিক্ষা শুধু না। সৃজনশীল ও মানবিক উৎকর্ষ যাতে বাড়ে সেই শিক্ষা আগে দিতে হবে সব শিশুদের। বীণার পরিশ্রম শুরু হল মানসিক ও শারীরিক।
এদিকে আদরে আবদারে বড় হচ্ছে ঝুমা, বীণার মতো মুখের আদল ওর, ভগবান প্রদত্ত সুরেলা কণ্ঠ স্বর পেয়েছে ঝুমা। সংগীত চর্চা নৃত্য সবেতেই পারদর্শী ঝুমা,দেখতে দেখতে ঝুমা আট বছরে পড়লো, লেখা পড়া গান নাচ সব চলছে। এর মধ্যে কলকাতার এক বিচিত্রা অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছে ঝুমা। বীণা খুব খুশি। “শিশুনিকেতন ভিটেমাটি”র অনেক শিশুই সুযোগ পেয়েছে ঝুমার দৌলতে। পয়লা বৈশাখের দিন সন্ধ্যা বেলায় অনুষ্ঠান। বীনা সবাইকে নিয়ে উপস্থিত হল সময়মতো। আনন্দ প্রধান অতিথি হয়ে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছে। বীণা আনন্দকে দেখে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিল।
ঝুমার নাম ঘোষণা হওয়ার পর ঝুমা মঞ্চে উঠে সবাইকে প্রণাম জানিয়ে বললো,
সব শিশুই আদরের
গরিব হোক বা ধনী
ভবিষ্যতের মুক্ত ওরা
যত্নে হবে গুণী..
আনন্দ মুগ্ধ হয়ে শুনছে ঝুমার কথা। নাচ গান সব হল ভালোভাবে।
আনন্দ মনে মনে ভাবছে, কোথায় আমার সন্তান কে জানে..অনেক অবহেলা করেছি একবার খোঁজ পাই ওর- বুকে জড়িয়ে ধরে বলবো বাবাকে ক্ষমা কর মা।
এবার পুরস্কারের পালা। ঝুমা সাহার হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন প্রধান অতিথি মহাশয় আনন্দ সাহা।
ঝুমা মঞ্চে উঠে সবাইকে প্রণাম জানিয়ে বললো, আমার মার হাতে এই পুরস্কার তুলে দিতে চাই আমার মা বীণা সাহাকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি, এসো মা..

আনন্দ বীণাকে দেখে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, বীণার মুখ চোখের জলে ভরে গেল,
আনন্দর আজ কোন লজ্জা নেই, অহং বোধ নেই আছে শুধু পিতৃসুখের হাতছানি।
আনন্দ আট বছর কোন খোঁজ নেয়নি স্ত্রী কন্যার তার জন্য আছে অনুতাপ। আনন্দ ঝুমার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে বললো, ধন্য তোমার মা।
বীণা ঝুমাকে বললো, ইনি তোমার বাবা প্রণাম করো। ঝুমা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, কোথায় ছিলে বাবা এতোদিন তুমি?
আনন্দ নিরুত্তর।
শুধু বীণার হাত ধরে বললো, ঘরে চলো..
বীণা কচিকাঁচাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ওরাও আমার সন্তান, ওদের ঠকাতে পারব না।
আনন্দ বললো, যদি আমি আসি তোমার সংসারে তাহলে থাকতে দেবে তো?
বীণার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সব বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে বললো, আমার সংসার আমি ফিরে পেলাম, তোরা পিতৃসুখ পাবি আজ থেকে। “শিশুনিকেতন ভিটেমাটি” আজ থেকে প্রাণ পাবে, প্রাণ, বলেই
নিজের খেয়ালেই গেয়ে উঠল বীণা, “খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে”।

Loading

Leave A Comment